‘মগজখেকো’ অ্যামিবা সংক্রমণ ভারতের এক রাজ্য, জনমনে আতঙ্ক।

ছবিঃ সংগৃহীত
দ্য বাংলাদেশ ন্যারেটিভ
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কেরালার সব থেকে বড় উৎসব ওনামের ঠিক আগেই ৪৫ বছরের শোভানা একটি অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে শুয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতেই জ্ঞান হারালেন। তার পরিবার তাকে ঐ অ্যাম্বুল্যান্সেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
এই দলিত নারী মালাপ্পুরাম জেলার একটি গ্রামে ফলের রস বোতলজাত করে জীবিকা অর্জন করতেন। কয়েকদিন আগে থেকে তার শুধু মাথা ঘোরা আর উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছিল। ডাক্তাররা কিছু ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তার অবস্থার খুব দ্রুত অবনতি হতে থাকে: শরীরের অস্বস্তি থেকে শুরু হয় জ্বর, তারপর ভয়ানক কাঁপুনি হতে থাকে। ওনাম উৎসবের যে দিনটা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই পাঁচই সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
ঘাতক রোগটি হলো ন্যাগ্লেরিয়া ফাওলেরি, সাধারণভাবে যাকে মগজখেকো অ্যামিবা বলা হয়।
মিষ্টি জলে থাকা এই আ্যামিবা নাক দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে। এটি এমনই এক অতি বিরল রোগ, যার চিকিৎসা হয়ত অনেক ডাক্তারকে তার পুরো পেশাগত জীবনে একবারের জন্যও করার প্রয়োজনই হয় না।
এই রোগটা আটকানোর জন্য আমাদের কিছুই করার ছিল না। শোভনার মৃত্যুর পরে আমরা রোগটার ব্যাপারে জানতে পারি,” বলছিলেন মিজ. শোভনার আত্মীয় ও পরিচিত সামাজিক কর্মকর্তা অজিথা।
এক বছরে আক্রান্ত ৭০, মৃত ১৯
কেরালায় এবছরে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৯ জন এই মগজখেকো অ্যামিবার আক্রমণে মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে যেমন রয়েছে একটি তিন মাসের শিশু, তেমনই আছেন ৯২ বছর বয়সী একজনও।
এই এককোষী অ্যামিবা সাধারণত মিষ্টি এবং উষ্ণ জলে থাকা ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। এই অ্যামিবা প্রায়-প্রাণঘাতী যে সংক্রমণ ঘটায়, তাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয় প্রাইমারি অ্যামিওবিক মেনিঞ্জিওএনসেফেলাইটিস বা পিএএম।
মিষ্টি জলে সাঁতার কাটার সময়ে মানুষের নাক দিয়ে প্রবেশ করে দ্রুত মগজের কোষে আঘাত করে এই অ্যামিবা।
কেরালায় ২০১৬ সাল থেকে এই রোগ চিহ্নিত হচ্ছে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও বছরে একটি বা দুটি সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসত। প্রায় সব ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু হতো।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সারা পৃথিবীতে ১৯৬২ সাল থেকে এই রোগী চিহ্নিত হয়েছে মাত্র ৪৮৮ জন। বেশিরভাগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়ার ঘটনা। রোগীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে।
তবে কেরালায় এই রোগীদের প্রাণে বেঁচে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর ৩৯ জন রোগীকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, যাদের মধ্যে ২৩ শতাংশের মৃত্যু হয় আর এবছর প্রায় ৭০টি ঘটনা সামনে এসেছে, মৃত্যু হয়েছে ২৪.৫ শতাংশ রোগীর।
চিকিৎসকরা বলছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ার অর্থ হলো অত্যাধুনিক পরীক্ষাগারগুলির মাধ্যমে রোগ বেশি করে ধরা পড়ছে।
“রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তবে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে। বেশি সংখ্যায় টেস্ট হচ্ছে আর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে বলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই কৌশলটা একমাত্র কেরালাতেই নেওয়া হয়েছে,” বলছিলেন থিরুভনন্তপুরম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান অরভিন্দ রেঘুকুমার।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করার ফলে বিভিন্ন অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ওষুধ আর স্টেরয়েডের মিশ্রণ দিয়ে অ্যামিবাটিকে ধ্বংস করে রোগীকে জীবিত রাখা সম্ভব হচ্ছে।
পুকুর, কুয়োর জল থেকে হতে পারে সংক্রমণ
বিজ্ঞানীরা পরিবেশে ঘুরে বেড়ায় এরকম প্রায় চারশো প্রজাতির অ্যামিবা চিহ্নিত করতে পেরেছেন, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ছয়টি অ্যামিবা মানুষের শরীরে রোগ বাঁধাতে সক্ষম বলে জানা যায়। এই ছয়টির মধ্যে একটি হলো এই ন্যাগ্লেরিয়া ফাওলেরি এবং আরেকটির নাম অ্যাকান্থামিবা, যে দুটি প্রজাতির অ্যামিবাই মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
কর্মকর্তারা বলছেন যে কেরালার সরকারি পরীক্ষাগারগুলি এখন পাঁচটি প্রধান প্রকারের সংক্রমণ নির্ণয় করতে সক্ষম।
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যটি তার জলের চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ জল আর প্রচুর জলাশয়ের ওপরে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সেকারণেই তাদের মগজখেকো অ্যামিবা সংক্রমণের বিপদও বেশি। বিশেষত যখন বহু জলাশয় আর পুকুরই দুষিত। গত বছর যেসব রোগী চিহ্নিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছোট একটি অংশের সঙ্গে এই দূষিত পুকুরের জলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল।
এক যুবক রোগী পাওয়া গিয়েছিল যিনি পুকুরের জলের মিশিয়ে ফোটানো গাঁজা সেবন করত। এরকম বিপজ্জনক অভ্যাস থেকেই বোঝা যায় যে দুষিত জলের মাধ্যমে কীভাবে মানবদেহে এই অ্যামিবার সংক্রমণ হতে পারে।
কেরালায় প্রায় ৫৫ লক্ষ কুয়া ও আরও ৫৫ হাজার পুকুর আছে। লাখ লাখ মানুষ শুধুমাত্র এই জলাশয়গুলি থেকেই দৈনন্দিন কাজের জন্য জল সংগ্রহ করেন। পুকুর বা কুয়োর সংখ্যা এতটাই বেশি যে এগুলিকে শুধুমাত্র ‘বিপজ্জনক’ বলে দেওয়াটা অসম্ভব, এই জলাধারগুলোই তো রাজ্যের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মেরুদণ্ড।
“কিছু সংক্রমণ ঘটেছে পুকুরে স্নান করার সময়ে, অন্যদের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে গিয়ে সংক্রমণ হয়েছে। এমনকি এক ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নাক দিয়ে জল টেনে নাসিকা-রন্ধ্র পরিষ্কার করতে গিয়েও কেউ কেউ সংক্রমিত হয়েছেন। দূষিত পুকুর হোক বা কুয়ো, ঝুঁকিটা কিন্তু থাকেই,” বলছিলেন মহামারি বিশেষজ্ঞ অনীশ টিএস।